প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অপরূপ লীলাভূমি কক্সবাজার জেলা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বঙ্গোপসাগরের কুলঘেষে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অপরূপ লীলাভূমি কক্সবাজার জেলা। নদী, সাগর, পাহাড়, পর্বত, ঝার্ন্নাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বৈচিত্র দিয়ে ঘেরা এই জেলাটি। আর এই জেলার প্রবেশদ্ধার চকরিয়া উপজেলার চিরসবুজ বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ ঘন জঙ্গলে আচ্ছদিত ডুলাহাজারাতেই অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্ক। যেখানে প্রবেশ করলে বনের পিনপতন নিস্তব্দতায় যেন গা শিউরে উছে। অসংখ্য বুনো গাছ গাছালির নীচে পড়ে থাকা শুকনো পাতার মরমর আওয়াজ চমকে দেয় মনকে। প্রখর রুদ্র তাপে ও সূর্যের আলো ঘন জঙ্গলের গাছগাছালির ঢালপালা কিংবা পাতা ভেদ করে মাটিতে পড়েনি কখনো। লোকালয় থেকে সরে প্রকৃতির এমনই নির্জনতাকে আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছেন হাজারো বন্যপ্রাণী, পশু ও পাখপাখালীর দল। এখানে যে প্রাণীটি সবচাইতে বেশি মানুষের নজর কাড়ে এবং বনের সৌন্দর্য বাড়িয়ে প্রকৃতিকে নিরাপদে রেখেছে সেটি হল চিত্রা হরিণের দল। হরিণ দেখা মানেই সুন্দরবন, নিঝুমদ্বীপ, পার্বত্য চট্টগ্রামের চির সবুজ বিশাল অরণ্যরাজি। মানুষ এক সময় ছুটে যেত সুন্দরবনে হরিণ দেখতে। সেখানে বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া ছোট ছোট খালে দল বেঁধে পানি খেতে আসা হরিণের দল দেখত মানুষ নৌকায় করে আসে। তাছাড়া শীত মওসুমে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনেও হরিণ দেখার স্বাদ নিত এ অঞ্চলের সৌখিন ভোগবিলাশী ও শিকারী মানুষ। তারা দল বেধেঁ রাত জেগে বনের ভিতর পাহারা বসাত। যখন ভোরের সূর্য উকি মারত তখন বনের ভেতর থেকে বের হয়ে পানি খেতে আসত ঠিক ওই সময় হরিণ দলের উপর শিকারীদের গুলির আওয়াজ শোনা যেত। বর্তমানে ক্রমবর্ধমান মানুষের চাপ, শিকারীর উৎপাত, বনভূমি নিধনসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে হরিণ বিলুপ্ত প্রায়। হরিণের এ প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্ক দেখিয়েছে বিরল দৃষ্টান্ত। বনের ভেতর অত্যন্ত কাছে থেকে হাতের নাগালে দেখতে পাবেন চিত্রা হরিণের দল। দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। দেখতে দেখতে কখন যে আপনার পাশে এসে গা এলিয়ে দেবে আপনি টেরও পাবেন না। বিকালে পার্কের প্রধান গেইট দিয়ে ঢুকে দ্বিতীয় গেইট পার হয়ে রাশিঁ রাশিঁ গগনচুম্বি গর্জন গাছের নীচ ও হরেক রকম লতাগুল্মের মাঝে দিয়ে যাওয়া মেঠো পথে অল্পটুকু সামনে হাটলেই লেকের ধারে বিচরণ করতে দেখা যাবে চিত্রা হরিনের দল। এ দেখে মনে হবে আপনি সুন্দরবন এসেছেন। তখন ক্লান্তিহীন শরীরে প্রশান্তির পরশ লাগবে।
এটি ১৯৮০-৮১ সালে হরিন প্রজনন কেন্দ্র হিসাবে চালু হয়েছিল। বর্তমানে এটি জীববৈচিত্র সংরক্ষণের জন্য নানা রকম গাছ গাছালি বুনো জীবজন্তুর ও পাখীর নির্ভয় আবাস স্থল এবং ইকো-ট্যুরিজম ও গবেষণার পাশাপাশি বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পূর্ব পার্শ্বে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজরা রিজার্ভ ফরেষ্টে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত বনাঞ্চলে সাফারী পার্কটি অবস্থিত। সাফারী পার্ক হলো সরকার ঘোষিত এলাকা যেখানে বণ্যপ্রানীদেরকে তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রতিপালন করা হয়।
এর মধ্যে দেশী-বিদেশি বন্য প্রাণীসহ পাখীর বংশবৃদ্ধি ও অবাধ বিচরণের সুযোগ পায়। পর্যটকগণ টিকিটের বিনিময়ে পায়ে হেঁটে বা যানবাহনে ভ্রমণ করে শিক্ষা,গবেষণা ও চিত্তবিনোদনের সুযোগ থাকে। সাফারী পার্ক চিড়িয়াখানা থেকে ভিন্নতর। চিড়িয়াখানায় জীব-জন্তু আবদ্ধ অবস্থায় থাকে আর সাফারী পার্কে মুক্ত অবস্থায় বিচরণ করে।
বর্তমানে এর আয়তন ৯০০ হেক্টর। এখানে বুনো জীব জন্তুর অবাধ চলাফেরা পর্যটকগণ উপভোগ করতে পারেন। এই পার্কে তথ্য ও শিক্ষা কেন্দ্র, প্রাকৃতিক ঐতিহাসিক জাদুঘর,পরিদর্শন টাওয়ার, পিকনিক স্পট এবং বিশ্রামাগার রয়েছে। কক্সবাজার জেলা সদর হতে উত্তরে পার্কটির দূরত্ব ৫০ কি:মি: এবং চকরিয়া সদর হতে দক্ষিণে ১০ কি:মি:। প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত নির্জন উঁচু নিচু টিলা,প্রবাহমান ছড়া, হ্রদ, আকাশচুম্বি বিচিত্র গর্জন এর মত সু-উচ্চ ঐতিহ্যবাহী প্রাকৃতিক বৃক্ষ চিরসবুজ বনের জানা-অজানা গাছ-গাছালি,ফলজ-ভেষজ উদ্ভিদ,লতাগুল্ল সহ দূ:প্রাপ্য ও বিলুপ্ত প্রজাতির অপূর্ব উদ্ভিদের সমারোহ ও ঘন আচ্ছাদনে গড়ে উঠেছে সাফারী পার্ক। এর ছায়া ঢাকা পথ,সবুজ বনানী, জানা-অজানা গাছের সারি, পাখি আর বানরের কিচিরমিচির সবকিছূ মিলিয়ে যেন এক অসাধারণ অনুভূতি। পথের ধারে উচু ওয়াচ টাওয়ারে দাড়িয়ে আপনি দেখতে পাবেন পুরো পার্কের সীমানা পর্যন্ত অপার সৌন্দর্য। পার্কের চারদিকে রয়েছে বেষ্টনী যাতে বন্যপ্রানীরা পার্কের বাইরে যেতে না পারে। পার্কের ভিতরে জীবজন্তুু ও পাখীর বেষ্টনী। বেষ্টনীর ভিতরে বাঘ,সিংহ ও তৃণভোজী প্রাণী প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাস করছে। শুধু তাই নয়, পুরো পার্কে দেখতে পাবেন বিভিন্ন প্রানীর ভাস্কর্য যা আপনাকে মুগ্ধ করবে।
সরেজমিনে পার্কের ভীতরে প্রবেশ করে প্রফুল্ল মনে ঘুরে দেখতে পাবেন ও উপভোগ করবেন গগন চুম্বী শতবর্ষী গর্জন ট্রি ও বাশঁ ঝাড়ের ভিতর দিয়ে যাওয়া পীচ ঢালা মেঠো পথে জীববৈচিএ। ঘন জঙ্গলের ভিতর হাটতে গিয়ে পিন পতন নিরবতায় দর্শনার্থীর গা যেন শিউরে উঠে। ঝি ঝি পোকা এবং পাকপাখালীর কিচির মিচির শব্দে ভাঙ্গে সেই নিস্তব্দতা। পার্কের ভিতর পিচ ঢালা মেটো পথের দু’ পাশে পশু ও পাখী শালায় খাঁচার ভেতরে আবদ্ধ হরেক রকমের প্রাণীগুলো পর্যটকরা ঘুরে ফিরে দেখছে। যেমন পশু শালায় রয়েছে বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ, সাম্বার, মায়া হরিণ, চিতা, খরঘোশ, বানর, শিয়াল, লামচিতা, উল্টোলেজী বানর, হনুমান, বনবিড়াল, পাখীশালায় উটপাখী, ময়ূর, দোয়েল, ময়না, বনমোরগ, সারষ,টিয়া, বাজ পাখী পানিতে জলহস্থি, কুমির, কচ্ছপ ও অজগর সাপ সহ নানা ধরনের প্রাণী ঘুরে ঘুরে দেখছে।তবে বাঘ ভাল্লুুক সিংহের জন্য রয়েছে আলাদা বিশাল বেষ্টনী। এ ছাড়া ও বিদেশি প্রাণী যেমন জেব্রা,ওয়াইলবিষ্ট, কদু,স্প্রীংবক ও পর্যটকদের নজর কেড়েছে।এছাড়া বাড়তি আকর্ষন হল পার্কের ভিতরের সচ্ছ পানিতে ভরপুর বিশাল প্রাকৃতিক লেকের ধারে ক্ষনিকের জন্য বসলে নীল পানির আভা দর্শনার্থীদের মনটা /শরীরটা জুড়িয়ে যায়। এ সময় লেকের ধারে বিচরণ রত হরিণের দল যেন সুন্দরবনকে ও হার মানায়। দেখা গেছে দর্শনার্থীদের কেউ তাদের বাচ্ছাদের নিয়ে হাতির পিঠে চড়ছে আবার কেউ অনেক উচুঁ পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে উঠে সাফারি পার্কের বিশাল এলাকা অবলোকন করছে।
তাছাড়া অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের লেক। শীত বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অতিথি পাখির আগমন ঘটে লেক পয়েন্টে। লেকজুড়ে হাজার হাজার লাল পদ্মের মাঝে পাখিদের ওড়াউড়িতে চোখ জুড়িয়ে যায় পার্কে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের।
প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে হিমালয়ের উত্তরে শীত নামতে শুরু করে। ফলে উত্তরের শীত প্রধান অঞ্চল সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীন, নেপাল, জিনজিয়াং ও ভারত থেকে পাখিরা উষ্ণতার খোঁজে পাড়ি জমায় বিভিন্ন নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে। এ সময় দক্ষিণ এশিয়ার নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল বাংলাদেশে হাজারো অতিথি পাখির আগমন ঘটে। বাংলাদেশের যেসব এলাকায় অতিথি পাখি আসে তার মধ্যে চকরিয়াস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক অন্যতম।
সাফারি পার্ক সূত্রে জানা যায়, যখন অতিরিক্ত শীত পড়া শুরু করে তখন অতিথি পাখির আগমন ঘটে এ লেকে। তারা সাধারণত বিশ্রাম নেয় লেকের পানিতে ভাসতে থাকা পদ্ম ফুলের উপর। এগুলো হাঁস জাতীয় পাখি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উড়ে আসা অতিথি পাখির মধ্যে সরালি, পচার্ড, ফ্লাইফেচার, গার্গেনি, ছোট জিরিয়া, পান্তামুখী, পাতারি, মুরগ্যাধি, পাতারী হাঁস, জলকুক্কুট, খয়রা ও কামপাখি রয়েছে।
এছাড়া মানিকজোড়, কলাই, ছোট নগ, জলপিপি, নাকতা, খঞ্জনা, চিতাটুপি, বামুনিয়া হাঁস, লাল গুড়গুটি, নর্দানপিনটেল ও কাস্তেচাড়া প্রভৃতি পাখিও মাঝে মধ্যে দেখা মিলে এই লেকে।
পার্কে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী চট্টগ্রামের একটি স্কুলের শিক্ষার্থি সুবহা বিনতে মামুন জানান, সারা বছরই পড়া লেখায় ব্যস্ত থাকি। গত ইদের বন্ধে মা বাবার সাথে পার্কে ঘুরতে এসেছি। খুব ভাল লাগছে। বিশেষ করে লেকে অতিথি পাখিদের কিচিরমিচির শব্দটাই বেশি ভাল লাগছে।
সাফারী পার্ক সম্পর্কে অতি অল্প সময়ে এক পলকে এর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে ধারনার জন্য রয়েছে প্রধান ফটকের বাম পাশে ডিসপ্লে ম্যাপ। পর্যটকদের পার্কের ভিতরে অনায়াসে বাঘ-সিংহসহ অন্যান্য প্রাণী পর্যবেক্ষণ করার জন্য পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, প্রহরা পোষ্ট রয়েছে। এখানে পার্কের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা আছে,আপনি চাইলে বাসে করে ঘুরে ঘুরে পুরো পার্কটি দেখতে পারবেন। তবে পায়ে হেটে পুরো পার্কটি ঘুরে দেখাই উত্তম। পার্কে ঢুকেই হাতের বামে ও ডানে দুটি রাস্তা চলে গেছে। বাম পাশের রাস্তা ধরে হাটা শুরু করলে পুরো পার্কটি ঘুরে আপনি অনায়াসেই ডান পাশের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবেন। প্রবেশ ফি ও অন্যান্য সর্বসাধারণের জন্য প্রবেশ ফিঃ ৫০ টাকা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রবেশ ফিঃ১৫ টাকা ।
সাফারি পার্কের ফরেস্টার মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, প্রতিবছরই পার্কের লেকে অতিথি পাখি আগমন ঘটে। বিশেষ করে যখন খুব বেশি শীত পড়ে তখনই বেশী পাখী আছে। এক সময় এখানে বিভিন্ন ধরনের অতিথি পাখির আগমন ঘটত। কিন্তুু এখন আগের মতো তেমন পাখি আসে না। তিনি আরও বলেন, লেকে অতিথি পাখিদের যাতে দর্শনার্থীরা বিরক্ত না করে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে সাফারি পার্কের তত্তাবধায়ক (রেঞ্জ কর্মকর্তা) মো.মোরশেদুল আলম বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে জীবজন্তুর নিরাপদ আবাসস্থল গড়তে ও দর্শনার্থীদের আকর্ষণ বাড়াতে সাফারি পার্ককে ঢেলে সাজানোর জন্য চলছে একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। গত ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে সরকারের বন মন্ত্রনালয়ের বরাদ্ধে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ যথাযত নিয়মে শেষ করেছে পার্ক কতৃপক্ষ। কাজ গুলো ছিল পার্কের বাইন্ডারী ওয়ালের বাইরে আরসিসি পরিখা খনন, রাস্তা ও কালবার্ট নির্মান। এসব উন্নয়নের কারনে পার্কের সুন্দর্য্য আরো বৃদ্ধি করেছে।
পাশাপাশি সংগ্রহ করা নানা প্রজাতির জীববৈচিত্র ও বন্যপ্রাণী গুলোর প্রজনন সক্ষমতার কারনে প্রতিবছর পার্কে বাড়ছে প্রাণী জগতে নতুন অতিথি। তিনি বলেন, পার্কের দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও ভেটেরিনারী বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিবিড় পরির্চযার কারনে বর্তমানে পার্কের নির্ধারিত বেস্টনীতে অবস্থান করা দুর্লভ প্রজাতির স্তন্যপ্রাণী চিত্রা ও মায়া হরিণের বংশ বিস্তার হয়ে প্রতিবছরই হরিণের সংখ্যা বেড়ে চলছে। প্রতিদিন হরিণের পাল পার্কের লেক ও আশপাশ এলাকায় অবাদে বিচরণ করছে। আর তা দেখে বেশ মুগ্ধ হচ্ছে পর্যটক-দশনার্থীরা।

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর